নিজস্ব প্রতিবেদক :
ফেসবুকের স্ট্যাটাসে চলনসই বাক্যরীতি ও শুদ্ধ বানানে দু’লাইন লিখতে না পারলেও অধ্যক্ষের তকমা লাগিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন জিল্লুর রহমান শিহাব। দাবি করেন বাবা ও দাদা শিক্ষক ছিলেন নিজেও শিক্ষক। শুধু শিক্ষক নন। শিক্ষক নেতা। স্বাধীন শিক্ষক পরিষদের সভাপতি। সব সময় মানুষকে রাজনৈতিক তত্ত্ব নিয়ে জ্ঞান দেয়ার চেষ্টায় পটু তিনি। সুন্দর চেহারার এ মানুষটির আদলের ওপিঠ উল্টালে মাকাল ফল দৃশ্যমান। তাকে নিয়েই আজকের মহাকাব্যের দ্বিতীয় পর্ব ‘শিহাবনামা (২)’। পাঠকদের জন্য বাবরনামার অনুকরণে শিহাবনামাকে কয়েকটি পর্বে বিভক্ত করে উপস্থাপনা করা হবে।
সুদূর ব্রাম্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার পানেশ্বর গ্রাম থেকে টাঙ্গাইলের গোপালপুরে পড়ালেখা করতে আসেন মনিরুজ্জামান অন্তর। প্রবাসী বোন জামাই নন্দনপুরের সিদ্দীক হোসেনের বাসায় থেকে নিজেকে বড় করার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। অন্তরের বাবার নাম সাইফুল ইসলাম। মাতার নাম ফৌজিয়া বেগম। ২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষে আসাদুজ্জামান একাডেমির কারিগরী শাখা হতে জিপিএ ৪.৬২ পেয়ে এসএসসি পাশ করেন। কিন্তু এসএসসি পাশের সার্টিফিকেট দেখে অন্তর হতভম্ব হয়ে যান। তার নিজের নাম হয়ে যায় মনির। বাবার নাম বদলে হয়ে যায় হাবিবুর রহমান। মাতার নাম বদলে হয়ে যায় মইফুল বেগম। এখন অন্তর নিরন্তর ছুটছেন নিজের নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম প্রকৃতটা ফিরিয়ে আনতে। ইতিমধ্যে এ ভুল নামের সনদ নিয়ে গোপালপুর কলেজে কারিগরী শাখায় উদ্যোক্তা উন্নয়ন শাখায় ইন্টারে ভর্তি হয়েছে। নানা ঝামেলায় এবার গোপালপুর কলেজ থেকে ফরমফিলাপ করতে পারেনি অন্তর। তবে সে হাল ছাড়েনি। একবার ছুটছে আসাদুজ্জামান একাডেমির শিক্ষক ফরহাদ সাবের কাছে। আবার গোপালপুর কলেজ অধ্যক্ষের কাছে। আসাদুজ্জামান একাডেমিতে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রী ও তার অভিভাবকের নাম খোলনলচেসহ কেন আমূল পাল্টে যায় গোপালপুর বার্তাসহ স্থানীয় মিডিয়াকর্মীরা অনুসন্ধান চালিয়ে চোখ ধাঁধানো তথ্য আবিস্কার করে।
অসাধু কসাইদের জবাই করা মহিষ যেমন মাংসের দোকানে এসে খাসী হয়ে যায়, তেমনি আসাদুজ্জামান একাডেমিতে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের নিজের নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম বদল হয়ে যায়। কসাইরা যেমন দোকানের কমদামি মহিষের মাংস খাসী হিসাবে চালিয়ে দিয়ে বাড়তি রোজগার করে, তেমনি আসাদুজ্জামান একাডেমির অধ্যক্ষ জিল্লুর রহমান শিহাব নাম পাল্টিয়ে ভূয়া রেজিস্ট্রেশনে ভর্তি ও ফরমফিলাপ করিয়ে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, আসাদুজ্জামান একাডেমিতে ভর্তির সময় প্রায়ই সীট খালি থাকে। এজন্য কৌশলে প্রতিবছর ছাত্রছাত্রী ভর্তি বা রেজিস্ট্রেশেনের সময় শেষ হবার আগে আগে খালি আসনের স্থলে ভূয়া নামে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে রাখা হয়। ক্ষুধার্ত বাঘ যেমন শিকারে বের হয় তেমনি আসাদুজ্জামান একাডেমির অধ্যক্ষ জিল্লুর রহমান শিহাব ফরম ফিলাপের আগে আগে পরীক্ষার্থী সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কারিগরী শিক্ষা বোর্ডের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এবং তার স্কুলের কয়েক সহকর্মী দুস্কর্মের সঙ্গী হিসেবে তাকে এই কাজে সহযোগিতা করে। এ জন্যই পরীক্ষার আগের রাতেও আসাদুজ্জামান একাডেমিতে ফরমফিলাপ হয় বলে প্রবাদ রয়েছে। এসব ফরমফিলাপে বিশাল অঙ্কের বানিজ্য হয়। নিশ্চয়তা দেয়া হয় নকলের অথবা ভালো রেজাল্টের। আর এ জন্যই শিক্ষক সমিতির সাথে পরিকল্পিতভাবে মতবিরোধ সৃষ্টি করে সূতি ভিএম পাইলট মডেল হাইস্কুল কেন্দ্র পরিত্যাগ করে আসাদুজ্জামান একাডেমিতে পৃথক ভেন্যু করা হয়। সেখানে চলে নকলের রমরমা ব্যবসা। সহজেই বিকানো হয় বাড়তি কামাইয়ের পসরা।
আজকের প্রতিবেদনের আলোচ্য মনিরুজ্জামান অন্তর ঠিক তেমনি এমন একটি অপব্যবসার শিকার। মনিরুজ্জামান অন্তরের মতো কমপক্ষে আরো পনেরো জন শিক্ষার্থীর সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা আসাদুজ্জামান একাডেমির ছাত্র ছিল এবং যাদের নিজের নাম, বাবার নাম, মাতার নাম কিছুর সাথেই মিল নেই। সনদ হাতে পাওয়া এসব ছাত্ররা এখন দল বেধে নিজের প্রকৃত নাম, বাবার নাম বা মাতার নাম পরিবর্তনের জন্য থানায় জিডি করতে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে অথবা আদালতে এফিডেভিটি করাতে বাড়তি শ্রম, ঘাম ও অর্থ খরচ নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ কারিগরী শিক্ষা বোর্ড ঢাকার কার্যালয়ে কয়েক মিডিয়াকর্মীকে পাঠিয়ে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
শিক্ষার নামে এ অপব্যবসার ফাঁদক জিল্লুর রহমান শিহাবের ফেসবুক স্ট্যাটাসে সম্প্রতি এক শিক্ষক নেতা মন্তব্য করেছেন, ‘দুই লাইন বাক্যের বানান শুদ্ধ করে লিখতে পারেন না, নিজকে অধ্যক্ষকে দাবি করেন কিভাবে?’
জিল্লুর রহমান শিহাব গোপালপুর মেহেরুনেচ্ছা কলেজের অধ্যক্ষ খন্দকার জাহাঙ্গীর আলম রুবেলের সাথে ছাত্রমৈত্রী করতেন। ১৯৯৪ সালে বিএনপির মহাসচিব ব্যারিস্টার আব্দুস সালাম তালুকদার গোপালপুর এলে পৌরশহরের আলীয়া মাদ্রাসা মাঠের এক সংবর্ধনা সভায় জাহাঙ্গীর আলম রুবেলের সাথে বিএনপিতে যোগদান করেন। গ্রেনেড় হামলা মামলার আসামী এবং সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু ছিলেন তখন সাংসদ।
গোপালপুর পৌরসভার ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ মনোনিত প্রার্থী মরহুম আব্দুল জব্বারের তীব্র বিরোধীতা করেন এই জিল্লুর রহমান শিহাব। বিএনপি মনোনিত প্রার্থী খন্দকার জাহাঙ্গীর আলম রুবেল ওই নির্বাচনে চেয়ারম্যান (মেয়র) নির্বাচিত হন। টানা তিন বছর আব্দুস সালাম পিন্টুর নেকনজরে থেকে বিএনপির কর্মী হিসাবে জিল্লুর রহমান শিহাব টুকটাক ঠিকাদারি করে দু’পয়সা কামাই রোজগার শুরু করেন। তখন তার বর্তমানের মতো বাস, ট্রাক, ফ্লাটবাড়ি, কোটি টাকার সহায় সম্পত্তি, ব্যাংক ব্যালেন্স কিছুই ছিলো না।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে খন্দকার আসাদুজ্জামান এমপি নির্বাচিত হলে জিল্লুর রহমান শিহাব ইচ্ছে করেই পল্টি খান। যোগ দেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগে। তারপর আর তাকে পিছু তাকাতে হয়নি। ঠিকাদারি, মোসাহেবী আর তৈলমর্দনকে পুঁজি করে সিড়ির শেষ ধাপে পৌছেছেন। এখন তিনি প্রায় চল্লিশ কোটি টাকা পুঁজি নিয়ে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় স্কুল কলেজের ভবন নির্মাণের ঠিকাদারি করছেন। স্বপ্ন দেখছেন গোপালপুর পৌর সভার মেয়র বা উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার। প্রার্থীতা জানান দেয়ার জন্য তিনি গোপালপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়কসহ বিভিন্ন পয়েন্টে রঙ্গীন পোস্টার ও ব্যানার ফেস্টুন লাগিয়েছেন।
জিল্লুর রহমান শিহাব টাকার পাহাড় গড়লেও অর্থগৃধূতা যায়নি তার। তাই মনিরুজ্জামান অন্তরদের মতো অসহায় শিক্ষার্থীদের ভূয়া রেজিস্ট্রেশনে অকার্যকর সনদ এনে দিয়ে দুহাতে টাকা কামানোর সুযোগ হাতছাড়া করছেন না। সব সময় ‘আমি এমপির লোক’ পরিচয়ে এবং অবৈধ কাজে এমপির স্বাক্ষর জাল করেন বলেও প্রতীয়মান হয়েছে।
সাংসদ খন্দকার আসাদুজ্জামানের সুপারিশ করা কিছু ডিও লেটার, যা জিল্লুর রহমান শিহাব ঢাকা ও টাঙ্গাইলের দুটো অফিসে জমা দিয়েছেন, তাতে স্বাক্ষরে কিছুটা অমিল দেখা যায়। কখনো পুলিশ ভেরিফিকেশন হলে জাল ডিও লেটারের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে জানান একজন পুলিশ কর্মকর্তা।
এদিকে জিল্লুর রহমান শিহাবের অবৈধ টাকা বা অবৈধ উপার্জনের বিষয়ে টাঙ্গাইল ও ঢাকাস্থ দুর্নীতি দমন অফিসে সংবাদকর্মীরা যোগাযোগ করলে জানানো হয়, কেউ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে দেখা হবে।
জিল্লুর রহমান শিহাব বরাবরই তার বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ কল্পিত ও বানোয়াট দাবি করে আসছেন।